ডিপ ওয়েব, ডার্ক ওয়েব নিয়ে আমাদের অনেকের মনে একটা প্রচন্ড রকমের রহস্যমন্ডিত আগ্রহ আছে যার মূল হলো সেগুলা সম্পর্কে প্রচলিত কিছু ভুল এবং অতিরঞ্জিত তথ্য । যেহেতু গুজব, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব বা অতিরঞ্জিত তথ্যে মানুষের আগ্রহ সবসময়ই বেশি থাকে, তাই এই আগ্রহকে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মূলধারার সংবাদপত্রগুলাও এই টপিকের উপর সত্য মিথ্যার মিশেলে খবর ছাপিয়েছে অগুনতি (১, ২, ৩) । ইন্টারনেট বা ইউটিউবে সার্চ দিলে মিথ্যা এবং অতিরঞ্জিত খবরের ভীড়ে আসল তথ্য পাওয়াটাই কঠিন হয়ে যায় । তাই, নিজের জানাশোনার মধ্যে যথাসম্ভব সঠিক তথ্য দেয়ার চেষ্টায় ইন্টারনেটের এই ব্যাপারটা নিয়ে কিছুটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করবো ।
১) ইন্টারনেট হচ্ছে তথ্যের সাগর । আর যখনি তথ্যের ব্যাপার আসে, সাথে সাথে চলে আসে তথ্য সহজে খুঁজে পাওয়া জনিত ব্যাপার, সেই তথ্য এবং তথ্যের আদান-প্রদানকারীর নিরাপত্তার ব্যাপার । তথ্য সহজে খুঁজে পাওয়ার এই চিন্তা থেকেই আসলো সার্চ ইঞ্জিনের ধারণাটা । বর্তমানে সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু সার্চ ইঞ্জিন হচ্ছে গুগল, ইয়াহু, বিং, ডাকডাকগো, বাইডু(চায়না) এগুলো । এরা ইন্টারনেটের যাবতীয় ওয়েবসাইট, সেসবের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো তাদের সার্ভারে নিয়মিত আপডেট করে থাকে এবং এই কাজে কোন ওয়েবসাইটের নির্মাতা নিজেও সাহায্য করতে পারে । তো, এই সার্চ ইঞ্জিনের ডাটাবেজে তথ্য যোগ করে রাখার এই ব্যাপারটাকে সহজ ভাষায় ইনডেক্সিং বলে । আর, সার্চ ইঞ্জিন নিজে থেকেও কিন্তু অনেক তথ্য নিজের তথ্যভান্ডারে যোগ করে নেয় । কিভাবে? এখানেই আসে সারফেস ওয়েবের ব্যাপারটা ।
২) আমরা উদাহরণ হিসেবে গুগলকে নিচ্ছি । যখন গুগলে কোন সাইট যোগ করা হয়, তখন সেটা সেই সাইটে অন্য কোন লিঙ্ক থাকলে সে/সেসব লিঙ্কেও যায়, সেখান থেকে আরও লিঙ্কে, এভাবে যতদূর যাওয়া যায়, সবগুলোকেই সে তার ডাটাবেজে যোগ করে নেয়, মৃত লিঙ্কগুলো চিহ্নিত করে । এভাবে বাড়তে থাকে গুগলের তথ্যভান্ডার । তথ্য এভাবে খুঁজে নেয়ার/পাওয়ার এই ব্যাপারটা “ক্রলিং” বলে । গুগলের এই ক্রলিং বটটাকে বলে গুগলবট, স্পাইডার নামেও অভিহিত করা হয় মাঝে মাঝে । এভাবে যে সাইটগুলো সার্চ ইঞ্জিনে ইনডেক্সিং করা সম্ভব হয় সেগুলা “সারফেস ওয়েব” এর অন্তর্ভুক্ত । উইকিপিডিয়া, ইউটিউব, বিভিন্ন পাবলিক ফোরাম, পাবলিক ওয়েব পেজ সবকিছুই এই সারফেস ওয়েবের অন্তর্ভুক্ত । অর্থাৎ, আমাদের ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটির বেশিরভাগ কাজ আমরা এই সারফেস ওয়েবেই করে থাকি । কিন্তু এটাই সব না । আসলে এটা কিছুই না । ইন্টারনেটের মোট ভলিউমের তুলনায় এই সারফেস ওয়েব ১ ভাগও না । তাহলে বাকি ৯৯ বা তার বেশি ভাগ তথ্য কোথায় গেলো?
সেটা গেছে ডিপে, মানে ডিপ ওয়েবে । ইন্টারনেটে তথ্য যতো যোগ হচ্ছে, সারফেস ওয়েবের অনুপাতটাও ততই কমছে । তো, এই ডিপ ওয়েব সম্পর্কে জানার জন্য আমরাও কিছুটা ডিপে যাই, কি বলেন?
৩) ডিপ ওয়েব কখনো ব্রাউজ করেছেন? করেছেন কিনা সেটা আপনি নাও জানতে পারেন, তাই আপনাকে কিছুটা সাহায্য করা যাক । ইয়াহু মেইল বা জিমেইলে অ্যাকাউন্ট থাকলে সেটা খুলুন । ইউজার নেম, পাসওয়ার্ড দিন । টা ডা ! আপনি ঢুকে গেলেন ডিপ ওয়েবে !! আশাহত হলেন? হওয়াটাই স্বাভাবিক । আপনার ডিপ ওয়েব সম্পর্কিত রহস্যময় জগত এতো সিম্পল হওয়ারতো কথা না !! আসলে এতোটাই সিম্পল এই ডিপ ওয়েব । সার্চ ইঞ্জিন যে পেজ বা পেজের অংশগুলো ক্রল করে সার্চ রেজাল্টে দেখাতে পারে না, সেগুলা সবই এই ডিপ ওয়েবের অন্তর্ভুক্ত । তো, ইয়াহু বা জিমেইলের শুধু ফ্রন্ট পেজ (যেটাকে ল্যান্ডিং পেজ বলে) এবং এই ধরণের পাবলিক পেজগুলাই সার্চ ইঞ্জিনগুলোতে ইনডেক্সড থাকে । আর, বাকি লক্ষ কোটি ব্যবহারকারীদের মেইলবক্স সবগুলাই ডিপ ওয়েব । এখন বুঝতে পারছেন, কেন ডিপ ওয়েব সারফেস ওয়েবের তুলনায় এতো বড়? সহজ ভাবে বললেঃ
আপনার মেইলবক্স? – ডিপ ওয়েব
আপনার ড্রপবক্স ক্লাউড অ্যাকাউন্ট? – ডিপ ওয়েব
আপনার ফেসবুকের ফ্রেন্ডস অনলি/অনলি মি পোস্ট? – ডিপ ওয়েব
নেটফ্লিক্স / হটস্টার / হুলু …… সাবস্ক্রাইবার অনলি প্রোডাক্ট – ডিপ ওয়েব
আপনার উইকিপিডিয়া / ইউটিউব /….. এর পার্সোনাল অ্যাকাউন্ট? – ডিপ ওয়েব
অর্থাৎ, ইউজার নেম, পাসওয়ার্ড বা বিশেষ অনুমতি ব্যতীত দেখা যায় না বা ইচ্ছাকৃতভাবে সার্চ ইঞ্জিনগুলো ইনডেক্সিং করে না, এমন যতো কিছু আছে সবই ডিপ ওয়েবের অন্তর্ভুক্ত । তাহলে কি আপনি ডিপ ওয়েব সম্পর্কিত উত্তেজনাপূর্ণ যা কিছু জানেন সবই ভুয়া? না, তা না । যা রটে তার কিছুটা হলেও ঘটে বলে একটা কথা প্রচলিত আছে (যেটা সবসময় সঠিক না)। এই খানিক ঘটাঘটির কাজগুলা হয় ডার্ক ওয়েবে, যেটা ডিপ ওয়েবের ছোট্ট একটা অংশ এবং প্রাইভেসি সংক্রান্ত ব্যাপারে আরও ডিপে অবস্থিত ।
৪) ডিপ ওয়েব এবং ডার্ক ওয়েবকে অনেকেই এক করে ফেলে, কিন্তু এই দুটো মোটেও এক না । এটা অনেকটা “সকল ক্ষারই ক্ষারক, কিন্তু সকল ক্ষারকই ক্ষার না” ধরণের । সকল ডার্ক ওয়েব ডিপ ওয়েবের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু ডিপ ওয়েব মানেই ডার্ক ওয়েব না । এবং ডিপ ওয়েবের মোট সাইজের তুলনায় ডার্ক ওয়েবও মাত্র ১ ভাগ বা তারও কম । ডার্ক ওয়েব হচ্ছে সেসব সাইট যেগুলো ইচ্ছাকৃত ভাবে সার্চ ইঞ্জিনের ইনডেক্স অপশন থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে এবং সাধারণত এগুলো ক্রোম, ফায়ারফক্স বা এই ধরণের সাধারণ ব্রাউজার দিয়ে ব্রাউজ করা যায় না, বরং স্পেশাল ব্রাউজার প্রয়োজন হয় । তবে, কিছু এক্সটেনশন এবং ভিপিএন এর মাধ্যমে নরমাল ব্রাউজার দিয়েও ব্যবহার করা সম্ভব । কেন ব্রাউজ করা যায় না, এটাও আসলে খুব কঠিন কিছু না । ডার্ক ওয়েবের জন্য যারা ওয়েবসাইট খোলে, তারা সাইটগুলো রেজিস্ট্রেশন করে “.onion” এবং এই ধরণের কিছু এক্সটেনশনের অধীনে (আমরা যেমন ব্যবহার করি .com, .net, .org, …….) এবং এই এক্সটেনশন সমৃদ্ধ সাইটগুলো ক্রোম বা এই ধরনের গতানুগতিক ব্রাউজারগুলো এলাও করে না । ফলে এসব সাইটে স্বাভাবিকভাবে ঢুকা যায় না । এই জন্য ব্যবহার করা সবচেয়ে বিখ্যাত এবং পরিচিত ব্রাউজার হচ্ছে TOR ব্রাউজার, যার পুরো অর্থ হচ্ছে The Onion Router এবং এখান থেকেই .onion এক্সটেনশনটার উৎপত্তি । এই সফটওয়্যারটা বানিয়েছিল আমেরিকান নেভীর তিনজন কর্মচারী, তাদের সংস্থার নিজেদের মধ্যে অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে তথ্য আদান প্রদানের উদ্দেশ্যে । তো, এই সফটওয়্যারটার বিশেষত্ব কী? যদি নিরাপত্তার হুমকি এবং অনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে থাকে, তাহলে এই ব্রাউজারটাকেই কেন ব্যান করে দেয়া হচ্ছে না বা ইন্টারনেট থেকে নামিয়ে ফেলা হচ্ছে না?
৫) ডার্ক ওয়েব নিরাপত্তার জন্য হুমকি এটা ঠিক না, বরং ডার্ক ওয়েবের ধারণাটাই এসেছে নিরাপত্তার খাতিরে । ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় সবাইই সম্ভবত প্রক্সি/ভিপিএন শব্দগুলার সাথে পরিচিত বা অন্তত নাম হলেও শুনেছি এবং বিভিন্ন দরকারে ব্যবহারও করেছি । এগুলা কি করে? এগুলা ব্যবহারকারীর কম্পিউটারের আইপি (ক্লায়েন্ট আইপি) এবং যে সার্ভারে তথ্য পাঠানো হচ্ছে সেই সার্ভারের আইপির মাঝে একটা মধ্যবর্তী আইপি হিসেবে কাজ করে । ফলে সার্ভার সাইড আইপি থেকে মনে হয় যেন মধ্যবর্তী আইপি থেকেই রিকোয়েস্ট আসছে । অর্থাৎ এটা আপনার পরিচয়কে গোপন করছে মধ্যবর্তী এক ধাপে । TOR-ও একই কাজ করে, তবে এক ধাপে না, বরং পেঁয়াজের (Onion) অনেকগুলো লেয়ারের মতো এই ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী আইপিও অনেকগুলো । অর্থাৎ, অনেকগুলো মধ্যবর্তী সার্ভারে বাউন্সিং এর মাধ্যমে এটা রিসিভিং এন্ডে পৌছায় এবং প্রতিবারেই এই মধ্যবর্তী ধাপগুলো ভিন্ন ভিন্ন হয় । গতানুগতিক প্রক্সি/ভিপিএন এর ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী একটা আইপিকে ব্যাক ট্র্যাক করতে পারলেই প্রকৃত ব্যবহারকারীর পরিচয় উদ্ধার করে ফেলা সম্ভব, কিন্তু TOR এর ক্ষেত্রে মধ্যবর্তী আইপি অনেকগুলো হওয়ায় এই ব্যাকট্র্যাক করাটা খুবই কঠিন হয়ে যায় । ফলে তথ্য এবং ব্যবহারকারীর পরিচয় উভয়ই থাকে নিরাপদ । তবে এই কাজটা আপনি নিজের কম্পিউটারে TOR ব্যবহার না করেও করতে পারবেন অন্য যেকোনো প্রক্সি সফটওয়্যার ব্যবহার করে । যেমন এই পোস্টটি লেখার সময় আমি দুই স্তরের প্রক্সি ব্যবহার করছি । আমার কম্পিউটারে ইন্সটল করা ভিপিএন সফটওয়্যারটি আমার ইন্টারনেট কানেকশন এর প্রকৃত আইপি অ্যাড্রেস কে লুকিয়ে রাখছে । আর, ব্রাউজারে ইন্সটল করা প্রক্সি এক্সটেনশনটি সেই ভিপিএন প্রদত্ত আইপির উপরে আরেকটা লেয়ার যুক্ত করছে । অর্থাৎ সার্ভার সাইড থেকে ব্যাকট্র্যাক করতে হলে দুইটি ধাপ পেরিয়ে আসতে হবে প্রকৃত আইপি পাওয়ার জন্য।
৬) এতো নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা সহকারে ইন্টারনেট ব্যবহার কেন প্রয়োজন এবং কারা করে?
অনেক কারণেই এটা প্রয়োজন হতে পারে । যেমন, গোয়েন্দারা, সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন কর্মীরা বা সাধারণ মানুষরাও, যারা নিজেদের মধ্যে তথ্য আদান প্রদান করতে চায় গোপনীয়তার সাথে । এরপর আছে মানবাধিকার কর্মী, হুইসেলব্লোয়ার(যারা বিভিন্ন সেন্সেটিভ ব্যাপারে তথ্য ফাঁস করে), সমাজ কর্মী, কোন রাজনৈতিক বা অন্য উদ্দেশ্যে গড়া দল যারা নিজেদের সংগঠনকে প্রকাশ্যে না নিয়ে এসে গোপনে কার্যক্রম চালাতে চায় । আছে এরকম আরও অনেকেই । যেকোনো কাজেই যেমন ভালোর পাশাপাশি খারাপ থাকেই, এখানেও গোপনীয়তাকে ব্যবহার করে খারাপ কাজে জড়াচ্ছে অনেকেই । এসব খারাপ কাজের মধ্যে আছে ইলিগ্যাল ড্রাগস এবং অস্ত্রের এর কেনাবেচা বা এই ধরণের কোন ইলিগ্যাল ব্যবসা, ইলিগ্যাল পর্ন (চাইল্ড বা রিভেঞ্জ পর্ন), পাইরেটেড বই বিক্রি সহ অন্যান্য । সিল্ক রোডের কথা আপনারা হয়তো অনেকে শুনেছেন, যেটা ছিল এইরকম অবৈধ ব্যবসার একটা ওয়েবসাইট । এসব কাজে টাকার লেনদেন মূলত করা হয় অনলাইনভিত্তিক একটা ভার্চুয়াল কারেন্সি “বিট কয়েন” এর মাধ্যমে, যেটায় প্রচলিত মুদ্রাগুলোর মতো কোন পাবলিক রেকর্ড থাকে না ।
তাই বলে কি এসব অবৈধ কাজ যারা করে তাদের ধরা যায় না? হুম, ধরা যায় । যেহেতু, ডার্ক ওয়েবে এই ধরণের সাইট আছে, তাই গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরাও এই জায়গাতেই ওত পেতে থাকে অপরাধী ধরার জন্য । ফলে নিরাপত্তায় নুন্যতম ঘাটতি থাকলেই অপরাধী ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এখানেই বেশি । যেমন, সিল্করোড ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা অনেক আগেই গ্রেফতার হয়েছে এবং মানি লন্ডারিং সহ বিভিন্ন কেইসে সে বর্তমানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছে । এই কারণেই ডার্ক ওয়েবের অপরিচিত সাইটে অকারণে ব্রাউজ না করাই ভালো । ব্রাউজ করলে বিপদে পড়বেন, তা না । বরং, সেই সাইটটাকে ট্র্যাকে রাখা কোন গোয়েন্দা “আপনি সাইট কেন ব্রাউজ করছেন” এই কিউরিসিটি থেকে আপনার পরিচয় ব্যাকট্র্যাক করার চেস্টা করলেও করতে পারে যার ফলে অকারণ হেনস্থা হওয়ার একটা ক্ষুদ্র সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে । এই সম্ভাবনা কিন্তু সারফেস ওয়েবের অনেক সাইটের ক্ষেত্রেও আছে । যেমন, bestg***.com নামের একটা সাইটের নির্মাতাকে জেলে পুরা হয়েছে সাইটটি নির্মাণের অপরাধে ।
৭) “ডার্ক ওয়েবে ঢুকলেই আপনার তথ্য অমুক তমুকের কাছে চলে যাবে”, “আপনাকে ট্র্যাক করা হবে”, “ঢুকলে বেরোতে পারবেন না কাজ শেষ করার আগ পর্যন্ত”, “আপনার ছবি এবং ব্যক্তিগত তথ্য চলে যাবে এডমিনের কাছে” এই কথাগুলা কি ভুয়া? হুম, এই কথাগুলা পুরাই ভুয়া । এই কথাগুলা ছড়ায় দুই ধরণের মানুষ । এক, ডার্ক ওয়েব ব্যবহারকারী লোকজন, যার মধ্যে সাধারণ ব্যবহারকারী থেকে উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী সবাইই আছে । তারা এটা করে কারণ, তারা চায় আপনি ভয় পান এবং সেসব নিয়ে না ঘাঁটেন । দুই, কম জানা অতি উৎসাহী পাবলিকরা, যারা কিছু একটা পেলেই ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মতো লাফানো শুরু করে না জেনেই । এই দুইয়ে মিলে ডার্ক ওয়েব সম্পর্কে পুরোপুরি একটা রহস্যময় জগৎ তৈরি হয়ে গেছে । আর, এই রহস্যময়তা আর মানুষের অজ্ঞানতাজনিত আগ্রহকে পুঁজি করে লাইক, শেয়ার, ইউটিউব ভিউ, পত্রিকার কাটতি সব ব্যবসাই চলছে পুরোদমে । ২০১৪ তে এক রেডিট ইউজারের মাধ্যমে প্রচার পায় আরেক ধরণের ওয়েবের কথা যেটাকে সে নাম দিয়েছিল “শ্যাডো ওয়েব” যেটা পরবর্তীতে পরিচিতি পায় লাইভ অত্যাচার, খুন, ধর্ষণ দেখানোর জায়গা হিসেবে । অথচ পুরো ব্যাপারটিই ছিল একটা বানানো গল্প যেটা তার লেখাটি পড়লেও সহজেই বুঝা যায় । কিন্তু, অনুমিতভাবেই মানুষ এই গল্পও বিশ্বাস করেছে নির্দ্বিধায় । তবে ব্যাপারটি খুব বেশিদূর এগোয়নি, কারণ এর স্বপক্ষে তেমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি ।
এর মানে আবার এই না যে, ডার্ক ওয়েব ব্রাউজ করতে গেলে কেউ আপনার ব্যক্তিগত তথ্য মেরে দেয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই । কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড, ব্যক্তিগত তথ্য এগুলা ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্যজন পেতে পারে কোন সাইট ব্রাউজ করতে গিয়ে আপনার কম্পিউটারে স্পাইওয়্যার বা ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে দেয়ার মাধ্যমে । আপনার কম্পিউটারে যদি এন্টিভাইরাস/অ্যান্টি ম্যালওয়্যার ইন্সটল করা না থাকে অর্থাৎ, ভাইরাসের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা না থাকে বা আপনি যদি এসব সম্পর্কে সচেতন না হন, তাহলে কোন সাইট ব্রাউজ করতে গিয়ে কোন লিঙ্কে ক্লিক করে ফেললে আপনার কম্পিউটারে ভাইরাস ঢুকে যেতেই পারে । অর্থাৎ, মোটামুটি পুরো ব্যাপারটাই ঘটছে আপনার অসতর্কতা বা অজ্ঞানতার কারণে । দৈনন্দিন প্রয়োজনে ব্রাউজ করতে গিয়ে হয়তোবা আপনারা এই ব্যাপারটা প্রায়শই খেয়াল করেছেন যে, কিছু কিছু লিঙ্কে ঢুকতে গেলে ব্রাউজার থেকে ওয়ার্নিং দেখায় । সেটা হতে পারে ইনভ্যালিড সার্টিফিকেট এর কারণে, স্পাইওয়্যার, ম্যালওয়্যার যুক্ত লিঙ্কের উপস্থিতির কারণে । মোটামুটি সতর্কতা বজায় রাখলেই এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যপারগুলো আপনি এড়াতে পারেন সহজেই । আর, কম্পিউটারে একটি ভিপিএন/প্রক্সি ইন্সটল করে নিরাপদ রাখতে পারেন নিজের পরিচয়ও, যদি চান ।
৮) যারা নিয়মিত ডার্ক ওয়েব ব্যবহারকারী তাদের বাইরে আপনিও যদি চান, সেই ক্ষেত্রে ডার্ক ওয়েবে অনেক দরকারী সাইটই (যেমন, পাইরেটেড বই এর সাইট) আছে যেগুলা আপনি নিজ প্রয়োজনে ব্রাউজ করতেই পারেন । প্রয়োজনে সেগুলো ব্যবহার করুন । আরেকটা প্রচলিত কথা হল, ডার্ক নেটের সাইট অ্যাড্রেস নাকি সহজে পাওয়া যায় না ! মনে সন্দেহ থাকলে TOR ডাউনলোড করে নিজেই কিছু ব্রাউজ করুন । ব্রাউজারে the hidden wiki লিখে সার্চ দিলে একটা উইকি পেজ আসবে যেখানে আপনি ক্যাটাগরিওয়াইজ অনেক ডার্ক নেট সাইটের লিঙ্ক পাবেন । ডার্ক নেটের সাইট লিঙ্কগুলার সমস্যা হল, অনেক সাইট যেহেতু অবৈধ বা ব্যক্তিগত কারণে খোলা, তাই, ওয়েবসাইট সাসপেন্ডেড বা লিঙ্ক ডেড হয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়েই । আর, আপনি ডার্ক নেটে যে জিনিসগুলো পাবেন, সেগুলার বেশিরভাগই সারফেস ওয়েবেও পাবেন । তাই, ডার্ক নেটে দেখেই “ওয়াহ”, “ওয়াহ” করার আগে সেই একই ক্যাটাগরির জিনিস সারফেস ওয়েবেও খুঁজে দেখুন পান কিনা ! ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভাবনা, পেয়ে যাবেন ।
নদী বা সাগরে নামলে দুটো ব্যাপার ঘটতে পারে । একঃ আপনি আপনার সীমানা জানলে নিরাপদে উপভোগ করতে পারবেন আর সাঁতার জানলে এবং নামলে পুরোপুরি উপভোগ করতে পারবেন । দুইঃ নিজের সীমানা না জেনে গভীর পানিতে গেলে ডুবে মরবেন । ইন্টারনেট হচ্ছে তথ্যের সমুদ্র । এই সমুদ্রকে কিভাবে নিজের প্রয়োজনে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়, সেটা শেখার জন্যও আপনার পয়সাও খরচ করতে হবে না । সারফেস ওয়েবেই যতো বিশাল তথ্যভান্ডার আছে, সেটাই আমাদের জন্ম থেকে মৃত্যুপর্যন্ত যেকোনো তথ্য জানার বা শেখার জন্য প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত। দরকার শুধু সেই শেখার এবং জানার আগ্রহ, এবং একটা যৌক্তিক মন । এইটুকু কষ্ট করার পরিবর্তে আপনি যদি মিথ্যা তথ্যের চাপে ডুবে যান, সেটার জন্য ইন্টারনেটকে দোষারোপ করা খুব একটা যৌক্তিক নয় বৈকি !
প্রকাশের সময়কালঃ অক্টোবর ২০, ২০১৭