করোনাভাইরাস এর ব্যাপারটা যখন প্রথম ব্যাপকভাবে গণমাধ্যমে আসতে শুরু করে, তখন New York Post এর একটা পোস্টে(লিঙ্কঃ ১) করোনাভাইরাসটি চায়নার উহানের(যেখান থেকে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে) একটি গবেষণাগার থেকে লিকড হয়েছে বলে একটি খবর প্রকাশ করা হয়। তাদের যুক্তি ছিল, পুরো চায়নাতে নভেল করোনাভাইরাস এর মতো এডভান্সড ভাইরাস নিয়ে কাজ করে এমন একটিমাত্র “মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব” আছে এবং সেটি উহানে অবস্থিত। যেহেতু উহান থেকেই রোগটা ছড়িয়েছে, সুতারাং, COVID-19 ভাইরাসটিও সম্ভবত সেই ল্যাব থেকেই লিক হয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল মেডিক্যাল জার্নাল Nature এ মার্চের ১৭ তারিখ করোনাভাইরাসের উৎপত্তি কোথা থেকে এবং কিভাবে, সেটা নিয়ে একটি আর্টিকেল প্রকাশিত হয়(লিঙ্কঃ ২)। আর্টিকেলটির pdf ভার্সন পাবেন লিঙ্ক ৩ এ। জার্নালটিতে COVID-19 ভাইরাসের ল্যাব থেকে লিক হওয়া সম্পর্কিত কন্সপাইরেসি থিওরিকে সরাসরি নাকচ করে দেয়া হয়েছে। কেন? বলছি সেটা। নামকরণ দিয়েই আমাদের আলোচনা শুরু করি।
১) নামকরণের সার্থকতাঃ
করোনাভাইরাসের বৈজ্ঞানিক নাম SARS-CoV-2, তবে কেন ভাইরাসটিকে COVID-19 বলা হয়?
ভাইরাসটি করোনা গোত্রীয়। সেখান থেকে এসেছে COVID (Corona Virus Disease) শব্দটি। ভাইরাসটি প্রথম শনাক্ত হয় ২০১৯ এ, চায়নার উহানে (লিঙ্ক ৪)। সেখানে থেকে এসেছে ’19’। সব মিলিয়ে এটা পরিচিত হয়েছে COVID-19 হিসেবে।
২) করোনাভাইরাসের প্রকারভেদঃ
করোনাভাইরাসের এখন পর্যন্ত ৭ টা স্ট্রেইন ধরা পড়েছে যেগুলা মানুষকে আক্রমন করে। এর মধ্যে SARS-CoV(সার্স), MERS-CoV(মার্স) এবং SARS-CoV-2(করোনা) হলো প্রাণঘাতী। বাকি চারটি ভাইরাস মানুষকে অসুস্থ করলেও সেগুলা প্রাণঘাতী না। বাকি চারটি ভাইরাস(HKU1, NL63, OC43 এবং 229E) মানুষকে অসুস্থ করলেও সেগুলা প্রাণঘাতী না।
৩) জিনগত গড়নঃ
বিজ্ঞানীরা SARS-CoV-2 এর দুটি ভিন্ন ভিন্ন নমুনার জিনগত গড়নের তুলনামূলক পর্যালোচনা করে জানিয়েছেন যে, এটি আগের করোনাভাইরাসগুলোর তুলনায় যথেষ্ট আলাদা হলেও বাদুর এবং বনরুইয়ে(pangolin) প্রাপ্ত করোনাভাইরাসের জিনোমের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। ল্যাবরেটরিতে তৈরি হলে আগেরগুলোকে স্যাম্পল হিসাবে নিয়ে সেভাবেই বর্তমান ভাইরাসটি তৈরি হতো, যেমনটা এখানে হয়নি। বরঞ্চ এক্ষেত্রে ভাইরাসটির মধ্যে এমন একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে যেগুলা পূর্ববর্তী করোনাভাইরাসগুলোর মধ্যে ছিল না।
এই ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের সবচেয়ে বেশি অভিযোজিত একটা অংশ হচ্ছে RBD(Receptor-Binding Domain) এবং এটা মানুষের শরীরের ACE2(Angiotensin-converting enzyme 2) রিসেপ্টরের সাথে আগেরগুলোর তুলনায় খুব এফেক্টিভলি সংযুক্ত হতে পারে। এই অভিযোজনটা পরিষ্কারভাবে প্রমাণ করে যে, এটা কোন ল্যাবরেটরিতে তৈরি ভাইরাস না, বরং আগের করোনাভাইরাস থেকে প্রাকৃতিক বিবর্তনের মাধ্যমে বিবর্তিত হওয়া একটি রূপ।
৪) কিভাবে মানুষের শরীরে এলোঃ
এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের ধারণা দুটি।
i) এটি বাদুর বা অন্য অন্য পশুর দেহে বিবর্তিত হয়ে সে অবস্থাতেই মানুষের শরীরে এসেছে এবং মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়েছে। তবে, এই অনুমানের ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে, বাদুর দেহ থেকে প্রাপ্ত করোনাভাইরাসের স্যাম্পল এবং মানুষের শরীরে প্রাপ্ত করোনাভাইরাসের স্যাম্পলের মধ্যে মিল হচ্ছে ৯৬ পারসেন্ট এবং সে ক্ষেত্রে যে RBD পাওয়া যায়, সেটা মানুষের শরীরের ACE2 এর সাথে সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে ততোটা এফেক্টিভ না। এই ক্ষেত্রে আসে দ্বিতীয় ধারনাটি।
ii) পশু থেকে এটি মানুষের দেহে আসার পর মানুষের শরীরেই বিবর্তিত হয়েছে। প্রাকৃতিক বিবর্তনের একটি ধাপে এটি ACE2 এর সাথে যুক্ত হওয়ার ফিচারটি পায়। এরপর মানুষ থেকে মানুষে ট্রান্সফার হতে থাকে। যতদিনে এটা প্রথম শনাক্ত হয়, ততদিনে এটা যথেষ্ট মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে যেটা একটা এপিডেমিক শুরু করার জন্য যথেষ্ট।
দ্বিতীয় ধারণাটি যদি সঠিক হয়, তবে সেটা অত্যাধিক ভয়ংকর। কারণ, যেহেতু বিবর্তনের বর্তমান পর্যায়ে সে এতোটা এফেক্টিভলি মানুষের শরীরে নিজেকে অভিযোজিত করতে পেরেছে, বিবর্তনের পরবর্তী কোনো পর্যায়ে সে আরও ভয়ংকর, আরও প্রাণঘাতী হবে না সেটার নিশ্চয়তা কি?
তথ্যসূত্রঃ